মিকুর ডায়েরী

Arindam Basu
5 min readDec 22, 2019

--

যেখানে মিকু তার দিনলিপি লিখে রাখে

মা আজকে আমাকে ঘরে আটকে দিয়ে ১০০ টা অঙ্ক করতে বলে গেল। কারা নাকি দরজা ঝাঁকাচ্ছে, আর আমরা নাকি কি গোলমাল করেছি, তাই। গোলমালটা বলছি।

মাস ছয়েক হল আমাদের পাড়ায় দুজন মাঝবয়সী লোক এসেছে, একজনের ডাকনাম জগাই, আরেকজনের নাম মাধাই। লোকদুটোকে দেখে মনে হয় ওদের কোন কাজ নেই যদিও সব সময় সব জায়গায় মাতব্বরী করে বেড়ায়। জগাই বলে লোকটা দামী দামী জামাকাপড় আর সানগ্লাস পরে ঘুরে বেড়ায়, লোকটার একমুখ দাড়ি, আর কপালে একটা লাল তিলক, খসখসে গলায় কথা বলে। আর মাধাই বলে লোকটা পিপের মত মোটা, তার হাঁড়ির মত মুখ, টাক মাথা, ঢুলুঢুলু চোখ, একমুখ দাড়ি, সারাক্ষণ পান খায়, আর যেখানে সেখানে পানের পিক ফেলে। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে মাঠের পাশে একটা পুরনো বাড়ির একতলায় লোক দুটো আর আরো কয়েকজন রোজ সকালবেলা বসে থাকে, আর ওদের সঙ্গে আরো পাড়ার চার পাঁচজন লোক সারাক্ষণ ওদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।বাবার কাছে সেদিন শুনলাম আজকাল আবার দুজনেই পাড়ায় নতুন কাউকে দেখলে নাকি বলে, তোমরা কি বেপাড়ার লোক, এখানে কেন এসেছ, যাও এখান থেকে, না হলে মার খাবে। আমাদের পাড়ায় প্রোমোটার বিকাশ কাকুর সঙ্গে লোকদুটোর দারুণ ভাব, যদিও মনে হয় না আর কেউ ওদের পছন্দ করে ।

তো সেদিন কি হয়েছে, বিকেলবেলা আমরা পাঁচজন মাঠে খেলতে গেছি, দেখি সেখানে জগাই মাধাই আর আরো কারা কারা আমাদের পাড়ার ইকবালকাকুর সঙ্গে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি সব বলছে।ইকবালকাকু আমাদের পাড়ার পুরনো লোক, তাঁর স্টেশনারী দোকান আছে, তাছাড়া তাঁর বেলুন তৈরীর শখ, দারুন দারুণ বেলুন বানিয়ে আমাদের জন্মদিনে, পারটিতে আমাদের তাক লাগিয়ে দেন, ইকবালকাকুর ছেলে রফিক আমাদের ক্লাসেই পড়ে, আমাদের ক্লাসটিমের গোলকিপার।

সেদিন দেখলাম মাঠে জগাই আর মাধাই ইকবালকাকুকে কি কারণে ধমকাচ্ছে, আর ইকবালকাকু হাতপা নেড়ে কি বলার চেষ্টা করছেন। আমাদের মধ্যে বিতান একটু ছেলেমানুষের মত আবদার করে, এসবের মধ্যে ইকবালকাকুকে বলল, “ও ইকবালকাকু, আমাদের সবাইকে একটা করে বেলুন দেবেন?” যেই না বলা, অমনি বলা নেই, কওয়া নেই, ইকবালকাকু কিছু বলার আগেই মাধাই বলে লোকটা বলে কি, “এ তু কৌন হ্যায় বে? কেয়া রে? বেলুন ফেলুন কুছ নেহি মিলেগা, চল ফোট।” একজন বড় মানুষের মুখে এরকম ইতর ভাষা শুনে আমার ভারি রাগ হয়ে গেল, আমি বললাম, “আপনি ওর সাথে ওরকম করে কথা বলছেন কেন?” আর যায় কোথায়। লোকটা রে রে করে তেড়ে এসে আমাকে হিন্দিতে যা তা করে কিসব বলতে লাগল, আর ওদের দলে বাবলু বলে একজন আমাদের দাসপুকুর বাজারে মাছ বিক্রি করে, আর পাড়ার জলসায় হিন্দি গান গায়, সে হঠাৎ আমার কান মুলে দিয়ে বলে কি “বেলুন ফেলুন কিচ্ছু পাবি না, যা ভাগ এখান দিয়ে”, আর কোথাও কিছু নেই, বিতানকে মারল ঠাস করে একটা চড়। আমাদের এমন অপমান লাগল আর রাগ হল কি বলব, কিন্তু কিছু বলতেও সাহস হল না, মারামারি তো দূরস্থান, ইস্কুল হলে মারামারি শুরু হয়ে যেত, এরা গুণ্ডা মনে হয়, এদের সবাই সমঝে চলে। কিছুই করতে পারলাম না, আর আমরা সবাই অপমানে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে এলাম। আমাদের যা বয়স, এ বয়সে এসব কথা অবশ্য বাড়িতেও বলা যায় না, হাজার হোক আত্মসম্মানের ব্যাপার। এর শোধ নিতে হবে। নেব কি করে?

পরের দিন সকালবেলা ঘুম ভাঙল একটা হইচইতে। আমাদের এদিকটা এখনো মফ:স্বলের মত, অল্পস্বল্প বাড়ি উঠছে এদিক ওদিক, মাঝে মধ্যেই কিছু লোক সাইকেল রিকসা করে চীৎকার করতে করতে যায়, সেরকমই চীৎকার করছে কেউ। লোকটা বলছে “আসুন আসুন দেখে যান বেলুনের বাহার! স্বনামধন্য জগদীপ লাল আর মাধো দাসের বিশাল বেলুন-কীর্তি পানুবাবুদের মাঠে দেখে যান!”

ও, এবার বুঝলাম। তার মানে জগাইয়ের ভাল নাম জগদীপ আর মাধাইয়ের নাম মাধো! বেলুন ওরা করেছে নাকি? ওটা তো কেউ তৈরি করে থাকলে ইকবালকাকু করেছেন। যাই হোক, বাড়ি থেকে ইস্কুল যাবার পথে বেরিয়ে দেখি সত্যি মাঠের ভেতরে দুটো বিচ্ছিরি দেখতে বিশাল কমলা রঙের (মা বলল ওটা অরেঞ্জ না, স্যাফ্রন রঙ) বেলুন দড়ি দিয়ে মাঠে একটা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা, একটার মুখে জগাইয়ের ছবি, আরেকটাতে মাধাইয়ের ছবি দেওয়া। তাই জন্যে মনে হয় কালকে ইকবালকাকুকে ডেকেছিল! দেখে এমন গা জ্বলে গেল, যাই গিয়ে কাঁচি দিয়ে দড়িদুটো কেটে দিই, কিন্তু দেখলাম মাঠে জগাই মাধাইয়ের দলের লোকগুলো পাহারা দিচ্ছে, কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না, তার মানে আমাদের বিকেলের খেলারও বারোটা বেজে গেল। এমন রাগ হল কি বলব। ইকবালকাকুর দোকানটা দেখলাম এখনো খোলে নি, তালা দেওয়া। ইস্কুলে গিয়ে রফিককেও দেখতে পেলাম না। কাল রাত থেকে নাকি ইকবালকাকুর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, আর আজ সকাল থেকে রফিকদেরও কেউ দেখে নি।

দুপুরে টিফিনের সময় আমরা পাঁচজন প্ল্যান করলাম বেলুনদুটোকে পিন ফুটিয়ে ফাটিয়ে দেব। কিনতু পিন ফুটিয়ে ফাটাতে গেলে তো বেলুনগুলোর কাছে যেতে হবে, এরকম সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় দেখি লানা আসছে। লানা’র সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। লানাও আমাদের পাড়ায় থাকে, গৌরবকাকুর মেয়ে। ওদের বিশাল বাড়ি, গৌরবকাকুর বিশাল নাম। গৌরবকাকু দারুণ ভাল ডাংগুলি খেলতেন, একবার আমাদের পাড়ার হয়ে ইন্টার-পাড়া ডাংগুলি কম্পিটিশনে পার্ক-স্ট্রীটের সাহেব পাড়ার ছেলেদের প্রায় একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন । জেভিয়ার্সের মাঠে খেলা হয়েছিল, আর ফাদারদের সামনে টেঁশোদের ইস্কুলে গৌরবকাকু গায়ের জামা খুলে এমন উড়িয়েছিলেন যে আমাদের বাবা-কাকা, ওদের বন্ধুরা সেই থেকে গৌরবকাকুকে দারুণ খাতির করে। গৌরবকাকু আমাদের পাড়ার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। সবথেকে বাজে ব্যাপার, মাধাইয়ের একটা মহা চালিয়াৎ ছেলে আছে,কেটলির মত মুখ(আমরা পেছনে কেটলি বলি), সে আবার ওই ক্লাবের সেক্রেটারি! লানা হচ্ছে সেই গৌরবকাকুর মেয়ে,আমরা ছোট থেকে চিনি, আমাদের ইশকুলেই পড়ে। লানা এসে বলল, “এই তোরা কি করছিস রে?” আমরা বললাম। লানা বলল, “দ্যাখ, পিন ফুটিয়ে তো ফাটাতে পারা যাবে না, তার চেয়ে বাপি ইদানীং ইংল্যাণ্ড থেকে ফেরার পর আজকাল বাড়িতেই খুব ডার্ট খেলে, বাপির কাছে অনেকগুলো ডার্ট আছে,আজকে চেয়ে রাখব, ওইগুলোর দারুণ sharp end, ছুঁড়লে বেলুন ফাটতে বাধ্য। যদি কিছু করা যায়। কিন্তু হাত দিয়ে ছুঁড়তে পারবি না। তোদের কারো কাছে তীর ধনুক আছে?” বিতান আর রাঘব, দুই ভাই ওদের কাছে ধনুক আছে, তীর নেই। বাড়িতে দুজনে যেখানে সেখানে তীর ছুঁড়ত বলে মাসিমা একদিন রাগ করে ওদের তীরগুলো ভেঙে দিয়েছেন। ধনুকটা এমনিই পড়ে থাকে।

আমরা মোটামুটি প্ল্যানটা এইরকম বানালাম: আমরা কাল একদম ভোরবেলা, আলো ফোটবার মুখে মাঠটায় চলে যাব, লানা গৌরবকাকুর ডার্ট, ওর কাছে একটা খেললা বন্দুক আছে, সেটা, রাঘব আর বিতান ওদের ধনুক দুটো নিয়ে আসবে, আমরা ডার্ট দিয়ে বেলুনগুলোকে ফাটিয়ে দেব।

উত্তেজনায় সারারাত আমার ঘুম হল না, বারবার করে ঘড়ি দেখছি, সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই খুব সাবধানে সদর দরজা খুলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। দুপা যেতেই দেখলাম লানা, রাঘব, আর বিতানও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। চারজনে মিলে মাঠে গেলাম। দেখি বেলুনদুটো পতপত করে উড়ছে, ধারে কাছে গুন্ডাগুলো নেই। এই সময়টা ফাঁকা থাকে। বিতান আর রাঘব লানার কাছ থেকে ডার্টগুলো নিয়ে পরপর মারতে শুরু করল, দুটো এদিক ওদিক পড়ে গেল, আর তিন আর চার নম্বরদুটো যাকে বলে ‘বুলস আই’! লাগার সঙ্গে সঙ্গে দুম করে আওয়াজ, বেলুন দুটো ফেটে পড়ে গেল, আর আমরা দে দৌড়। হাঁপাতে হাঁপাতে যে যার বাড়িতে ভাল মানুষের মত গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কে কোথায় বেরিয়ে ছিল, কি করছিল খেয়াল করিনি।

এর পর নাকি সাংঘাতিক ঝামেলা হয়েছিল। আওয়াজ শুনে জগাই আর মাধাই বেরিয়ে এসে যখন দেখেছিল বেলুনদুটো ফেটে গেছে, বেদম চটে ছিল তো বটেই, কিন্তু যারা ওদের দেখেছিল তারা বলেছিল, জগাই বলে লোকটা নাক হাউ হাউ করে কাঁদছিল। এই ঘটনার পরে দুজনেই কয়েকদিনের জন্য পাড়া থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডার্টগুলো ছিল বলে গৌরবদার ওপর লোকের সন্দেহ হয়, যদিও গৌরবদা সবাইকে বলছিলেন, উনি কিচ্ছু জানেন না, খবরদার যেন ওনার মেয়ের ওপর সন্দেহ না হয়। আপাতত আমাদের ক’দিন ইশকুল যাওয়া বন্ধ। আমি তো ঘরে বন্দি। লানাও শুনলাম বাড়িতে বেজায় বকুনি খেয়েছে, তিন দিন খাওয়া বন্ধ, ঘরে বন্ধ করে রেখেছে। জগাই মাধাইয়ের চেলা চামুণ্ডারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আমাদের হাতে পেলে মার দেবে বলে।

তো এই হচ্ছে গোলমাল। শুনলেন তো সব।

--

--

Arindam Basu
Arindam Basu

Written by Arindam Basu

Medical Doctor and an Associate Professor of Epidemiology and Environmental Health at the University of Canterbury. Founder of TwinMe,

No responses yet